এরপর একসাথে বাড়ি ফিরলাম না আমরা। প্রথমে ফিরলাম আমি আর তার অনেক পরে ফিরলো খোকাভাই, একেবারে সন্ধ্যা পেরিয়ে। প্রতিদিনই কলেজ থেকে বিকেলে বা দুপুরে বাড়ি ফিরি যখন তখন কোনো সমস্যাই থাকে না মানে নিশ্চিন্ত মনে ড্যাং ড্যাং করে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে সারা পাড়া কাঁপিয়ে ফিরলেও নো প্রবলেম অথচ আজ ফিরলাম চোরের মত, নিঃশব্দে নীরবে। তবুও কুল রক্ষা হলো না। বাড়ির দরজায় পা দিতেই বুক ধুকপুক ধড়াম ধুড়ুম শুরু হয়ে গিয়েছিলো। নিজের বুকের ভেতরের হাতুড়ির শব্দ নিজেই শুনছিলাম আমি। অবশ্য মা বা কেউই খেয়াল করলো না। দরজা খুলে দিলো ললিতা মাসী। আমি সামনের গেইট দিয়ে না ঢুকে খিড়কী দুয়ারে ঢুকেছিলাম যেন কারো চোখে না পড়ি। ললিতা মাসী দুপুরের ভাত ঘুম ভেঙ্গে এসে হাই উঠাতে উঠাতে দরজা খুলে দিলো। ভালো করে দেখলোও না আমাকে। দুপুরের পর ভাতঘুম থেকে উঠে এসে তার চোখ তখনও আধ বোঁজা।
হঠাৎ প্যাক প্যাক করে ছুটে এলো রাজহাঁসের দল। বাড়ির পেছনের খিড়কী দূয়ারের পাশেই আমাদের পুকুরে সারাদিনমান সাঁতরিয়ে বিকেলে এসে জল থেকে উঠে ওরা বাগানে ঝিমায়। সন্ধ্যার আগ দিয়ে ললিতা মাসীই তাদেরকে এই দূয়ার খুলে ভেতরে নিয়ে আসে। আজ হঠাৎ আগে ভাগেই দুয়ার খোলার শব্দ পেয়ে আর ললিতা মাসীর গলা শুনেই বুঝি তন্দ্রা ভেঙ্গে ছুটে এলো ওরা। হাতী যখন কাঁদায় পড়ে ব্যাঙও তাকে লাত্থি মারে নাকি অথবা অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়, মানে ঠিক কোন প্রবাদ প্রবচনটি এখানে খাঁটবে বলোতো জলদস্যু ভাইয়ামনি?
লিখতে গিয়ে কেনো এমন প্রবাদ প্রবচন মনে পড়ছে সেটা বলি, অমন শুনশান নীরব সন্ধ্যার আগেভাগে চুপচাপ লুকিয়ে বাড়ি ফেরার উপযুক্ত পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও এমনকি বাড়ির লোকজনও ঐ পড়ন্ত বিকেলে অনেকেই ঢিলেঢালা ও আমার দিকে কোনোরকম মনোযোগী না থাকা সত্ত্বেও কোত্থেকে যে উড়ে এসে জুড়ে বসলো সেই গগণ বিদারী হাঁক ডাক প্যাক প্যাক কোয়াক কোয়াক! সেই শব্দে ললিতা মাসীর আধবোজা চোখ পুরো খুলে গেলো। চরম বিরক্তিতে উনি গলা খেকিয়ে গালাগাল শুরু করলেন ঐ অবলা জীবদের উপর। "আ মর জ্বালা এই বিকেল বেলাতিই কি রকম গাঁক গাঁক করে চিল্লুচ্ছে হারামজাদাগুনু। ঝাঁটা দিয়ে পিটোয় তোদের ছাল ছাড়াবানে হারামজাদারা। বাড়িতে কি ডাকাত পড়িছে যে অমন চিলাচ্ছিস হাবাতের বাচ্চারা! রাশ রাশ খায় আর রাশ রাশ হাগে তবুও এদের শরম হয় না।" এত গালাগালেও ওরা কর্ণপাত না করে সেই প্যাক প্যাক কোয়াক কোয়াক রবে ললিতা মাসীর শাড়ির প্রান্ত ওদের ছুঁচালো ঠোট দিয়ে টেনে টেনে তাকে অস্থির করে তুলেছিলো।
অন্য সময় হলে ললিতা মাসীর এ হেন গালাগাল আর হাঁসেদের কর্মকান্ডে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতাম আমি কিন্তু আজ ভয়ে কাঁটা হয়ে গেলাম কারণ ললিতা মাসীর গালাগাল আর রাজহাঁসেদের ঐ সন্মিলিত চিল্লাচিল্লির সন্মেলনের শব্দে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং মা জননী, আমার সেদিনের সাক্ষাৎ জম। আমার মুখে কি ছিলো জানিনা কিন্তু মায়ের মুখ নিমিষে অগ্নিবর্ণ ধারণ করলো। ললিতামাসীর গালাগাল, রাজহাসেদের সন্মিলিত সঙ্গীত সব ছাড়িয়ে মায়ের অগ্নি দৃষ্টির অগ্নিবাণ এসে পড়লো আমার উপরে।
মা চিরকাল দুপুরের ঘুম দিয়ে উঠে পাঁটভাঙ্গা শাড়ি পরতেন, কপালে লাল টকটকে বড় টিপ, মুখে ক্রিম পাউডার লাগিয়ে একেক দিন একেক ছাঁদে খোঁপা বাঁধতেন। খোঁপা বাঁধায় আজকাল বিউটিশিয়ানরা নানা রকম যন্ত্র ব্যবহার করে। সিল্কি চুল, কার্লি চুল ফ্রেঞ্চ বান, অনিয়ন বান, বাটারফ্লাই বান কত রকমের বান আর নান যে আছে কিন্তু আমাদের মায়েরা কখনও বিউটি পারলার যেতেন না। তারা বাড়িতেই ছিলেন একেকজন দক্ষ বিউটিশিয়ান। আমার ছোট চাচী তো আজকাল যে জট পাকিয়ে চুল পাফ করে বিউটি পারলার সেটাই জানতেন। আমি সে সব দেখে আমার ছেলেবেলা থেকে ও কৈশোর পেরিয়ে তরুনী হয়ে ওঠা বেলাতেও অবাক হতাম।
সারাদিন বাড়ির বউ এরা যে যত কাজ করুক বিকালবেলা পরিপাটি হয়ে থাকতে হবে এই ছিলো দাদীমার হুকুম। তাই সব চাচীরাই বিকেল হতেই সকলেই পরিপাটি হয়ে দাদীমাকে ঘিরে বসতেন। এক এক ছেলে বাড়ি ফিরতো এবং কেউ কেউ রাত করেও তবুও সকলেই প্রথমে দাদীমার সাথেই দেখা করে তারপর নিজেদের ঘরে ঢুকতেন। ও বাড়ির মেয়েদের কেশ পরিচর্যার এক আলাদা স্টাইল ছিলো। দাদীমা বাড়ির গাছের নারকেল পেড়ে সে সব টুকরো করে কেটে রোদে শুকিয়ে জ্বাল দিয়ে নিজেই বাড়িতে তেল বানাতেন। তাতে থাকতো মেথী, আমলকী নানা রকমের মহিলা কবরেজ আমার দাদীমারই কেরামতী। আর সেসব তেল ছাড়া বাজারের তেল মেয়েদের এমনকি ছেলেদের চুলে দেওয়া নিষেধ ছিলো। আজকাল তো ছেলেরা কেনো মেয়েরাও চুলে তেলই দেয় না। আমাদেরকে দিতে হত নিয়ম করে। বিকেলে বাড়ির সবগুলো মেয়েকেই বেঁধে দেওয়া হত নানা রকম বেনী। লম্বা বেনী, এক বেনী দুই বেনী এমনকি আমার খুব খুব পছন্দের কলাবেনীও। যাইহোক ঐ বাড়ির সকল মেয়েদের ঘন কালো সুন্দর চুলের রহস্যই আসলে ছিলো আমার দাদীমার ঐ তেলের কেরামতী।
চুলের কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেলো বন্দী টাওয়ারের র্যাপাঞ্জেলের কথা। তার জন্য আমার বিশেষ কষ্ট হত। যদিও কষ্টের পরে ঐ রাজকুমার যে চুল বেয়ে উঠে গেলো উঁচু টাওয়ারের চূড়োয় এবং রাজকন্যাকে উদ্ধার করলো সেই রোমাঞ্চকর ব্যপারটা ভেবে আনন্দিত হতাম আমি। ঠিক তেমনই কখনও কখনও কল্পনায় ভাসতাম। আমিও কি ছিলাম না আসলে অমনই এক বন্দী রাজকন্যা! যার ইচ্ছে অনিচ্ছের কানাকড়ি মূল্য না দিয়ে জোর করে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো বড়দের শাসন বারণ ইচ্ছে অনিচ্ছের বেড়াজালে!
যাইহোক এতক্ষনে নিশ্চয় সবাই ক্লান্ত হতে হতে অধীর হয়ে উঠেছেন নীরুর অগ্নিমূর্তি মা নীরুর পিঠে কয়টা তাল ফেললো না জানতে পেরে। না মা সেদিন কোনো তালই ফেলেননি। শুধু দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে উঠলেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? আমি আমতা আমতা করে কি বলেছিলাম সে কথা আমার নিজেরও আজ মনে নেই। তবে মায়ের চেহারা দেখে মনে হয়েছিলো তিনি আজ বাড়ি মাথায় তুলবেন। কিন্তু কিছুই করলেন না মা। একদম নীরব হয়ে রইলেন। ঝড়ের আগে সারা পৃথিবী যেমন শুনশান হয়ে যায় আমিও জানতাম মা চুপ হয়ে থাকার পাত্রী না। ঝড়টা তিনি জানিয়ে আনবেন না। অতর্কিত কালবোশেখীতে তছনছ করে দেবেন আমার জগৎ সংসারের সবকিছু।
আর ঠিক তাই হলো।
সে রাতে মা আমাকে কিছু বললেন না বটে এমনকি বাড়ির কাউকেই কিছু জানালেনও না কিন্তু আমি ঘুমিয়ে যাবার পরে আমার পড়ার টেবিল খাতা বই, ছবি আকার কাগজ পত্র কলম পেনসিলের বাক্স, কলেজের ব্যাগ ক্লিপ চুড়ি দুল মালার বাক্স, পুতুলের বাক্স যেখানে যা ছিলো সব লন্ডভন্ড করে ছাড়লেন। দাগী আসামীর আলামত সংগ্রহে তুখোড় গোয়েন্দা যেমন পাগল হয়ে ওঠে মারও ঠিক তেমনই অবস্থা হয়েছিলো সেদিন। কিন্তু আমার সকল একান্ত সম্পত্তি তছনছ করেও মা কোনো সুস্পষ্ট প্রমান পেলেন না যার জোরে উনি আমার পিঠে তাল নারকেল ফেলবেন। কিন্তু মায়ের কপালের চোখকে ফাঁকি দিলেও মনের চোখকে কিছুতেই ফাকি দেওয়া গেলো না। অবশ্য মা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবতেও পারলেন না যে আমার সাহস এতটাই বাড়তে পারে যে আমি নদী পাড়ি দিয়ে ও পারের কোনো গাঁও গেরামে সারা দিনমান কাঁটিয়ে আসতে পারি কারো সাথে সকলের অজান্তে। আমাকে নিয়ে মা এতটাই উন্মাদ ছিলেন যে কেউ আমার একটু হাতও ধরেছে এ কথা ভাবলেও তাকে হয়ত খুন করে জেইলে যেতেন। কাজেই মা ঠিকই বুঝলেন আমি কিছু একটা অঘটন ঘটিয়েছি বটে কিন্তু প্রমানহীন ছায়ার সাথে কি করে লড়বেন উনি?
খোকাভাই ফিরেছিলো আরও অনেক পরে। সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন ঘন কালো রাত। তাকে বিশেষ কেউ খেয়ালও করেনি। কিন্তু আমার সজাগ কানে তার খুট করে চলার শব্দও খুব সুক্ষ ছিলো আর তাই খোকাভাই যখন নীচের উঠোনে সাইকেল রাখলো আর তারপর অতি সন্তর্পণে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো তখন তার খুব ক্ষীন পদশব্দটুকুও ঠিক ঠিকই বুঝেছিলাম আমি। তখন মনে হয় রাত প্রায় ১০টা। মায়ের ওমন থমথমে মুখ দেখে আমি বেশি কথা না বাড়িয়ে সুবোধ বালিকা হয়ে হাত মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসেছিলাম। তারপর রাত একটু বাড়তেই রাতের খানাপিনা সেরে শুয়ে পড়েছিলাম। আসল উদ্দেশ্য সেদিনের সেই কিছুক্ষনের জন্য হলেও ঘর পালিয়ে বাঁধনহারা সেই সুমধুর লগনটুকুর স্মৃতির রেশ নিয়ে একটু স্মৃতি রোমন্থন করে আন্দোলিত হওয়া। সে সুযোগটুকু পর্যন্ত পাচ্ছিলাম না মায়ের রক্তচক্ষু শাসনের জ্বালায়।
তো লাইট নিবিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়তেই সারাদিনের সকল স্মৃতি হুড়মুড় করে নামলো আমার চোখের পাতায়। চোখ বুঁজে ভাবছিলাম আমি আজকের পুরো এপিসোডটা। খোকাভায়ের সাথে সেই মেঠোপথ ধরে সাইকেলে টুং টাং ভেসে যাওয়া। নৌকা করে ওপারের অজানায় গিয়ে ভেড়া অচেনা গাঁয়ের কথা। মাছরাঙ্গা কচুরীপানা লবঙ্গলতিকারা সব চলচ্চিত্র হয়ে ভাসছিলো আমার বন্ধ চোখের তারায় তারায়। সবশেষে প্রদীপদের বাড়ির ঐ মাটির ঘরে খোকাভায়ের সাথে কাঁটানো একান্ত কিছু মুহুর্ত। খোকাভায়ের বুকে মুখ গুঁজে নিশ্চিন্ত নির্ভার এক অজানা অচেনা পৃথিবীতে চলে যাওয়া। অনেকটা সময় ওভাবে ছিলাম আমরা। মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল যদি এভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যেত, তবে আর চাইবার কিছুই ছিলো না। আহা যদি এমন হত এই পৃথিবীতে আর কোথাও কেউ নেই। কোনো ভয় নেই, হুমকী নেই, বাঁধা নেই, নেই কোনো শাসন, নেই কোনো রক্তচক্ষু হিম শীতল নিষেধের বেড়ি। এই নিশ্ছিদ্র নিরুপদ্রব পৃথিবীতে আমরা শুধুই দু'জন মানব মানবী।
আমি জানিনা ঐ জেইলখানার মত প্রহরায় থেকেও, অত শাসন বারণ বিধি নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকেও কি করে অমন সাহসী হয়েছিলাম আমরা সেদিন! আমাদের ঘাড়ে বুঝি ভূতই ভর করেছিলো। বিষম সাহসী সেই ভূত। তবুও সেই ভূতের কাছে কৃতজ্ঞ থাকি আমি। সেই বেষম সাহসী অজানা ভূত ভর না করলে কখনও কি জানা হত আমাদের অমন অজানা অচেনা বাঁধনহারা, আশ্চর্য্য মায়াবী এক মুক্ত পৃথিবীর স্বাদ! ক্ষনিকের জন্য হলেও যা পাওয়া হয়েছিলো আমাদের! সেই অবাধ, স্বাধীন, অসম্ভব এক প্রশান্তির পৃথিবীর স্ব্প্ন চোখে নিয়ে চোখ বুজি আমি। আমি ঘুমাই কিন্তু আমার স্বপ্নে জাগে সেই ছায়া সুশীতল মাটির বাড়িটির মধ্য দুপুর। ঝাঁকড়া চুলের এক পরম ভালোবাসার সদ্য তারুন্যের এক মায়াময় যুবক। সেই আলিঙ্গন সারা শরীরে জড়িয়ে এক অভূতপূর্ব মোহ এবং মায়ায় ডুবে যাই আমি।
জানিনা ঠিক তখন রাত কয়টা বেঁজেছিলো। হঠাৎ ঐ মফস্বল শহরের সূচীভেদ্য অমাবশ্যা রাত্রীর নিরবতা ভেঙ্গে শোনা গেলো একটি আর্ত কন্ঠের আর্তনাদ। ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলাম আমি। সাথে সাথে শুনতে পেলাম উঠোনের মাঝে বাড়ির কাজের লোকজন থেকে শুরু করে সেজচাচা ছোটচাচা আরও কারো কারো পুরুষ কন্ঠের উত্তেজিত আওয়াজ! দাদুর গলায় শুনতে পেলাম বুঝি। দাদু বলছেন পুলিশে খবর দাও। কারা যেন বলছে দড়ি আনো। বাঁধো। এরই মধ্যে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থেকে চাচীমা দাদীমা সকলেই ঘুম ভেঙ্গে উঠে পড়েছে। সবাই জড়ো হয়েছে দাদীমার ঘরে। ভয়ে আমার পা চলছিলো না। গলা দিয়ে কথাও বের হচ্ছিলো না। আমি অনেক সাহস সঞ্চয় করে উঁকি দিলাম জানালা দিয়ে। দেখলাম উঠোনের মাঝ বরাবর যেই পেয়েরা গাছটা আছে ওর সাথে দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা হয়েছে শুকনো লিকলিকে কালো মতন একটা লোককে। লোকটার চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো। হাউ মাউ করে কি যেন সব বলছিলো। কাজের লোকেরা দু এক ঘা করে বসিয়েই যাচ্ছিলো।
বাড়ির ছেলেরা সবাই বের হলেও বাড়ির কোনো মেয়েরাই বের হলোনা ঘর থেকে। সবাই জেগে উঠেছিলো কিন্তু বাইরে বের হয়নি। ঘরের জানালা দরজা বা পর্দার ফাঁক দিয়ে হুমড়ি খেয়ে দেখছিলো। হঠাৎ খোকাভাইকে দেখলাম আমার জানালার পাশেই।এই হট্টগোলে মরা মানুষও জেগে উঠবে সে জানি কিন্তু খোকাভাই সহজে কখনও কারো ব্যপারেই মাথা গলায় না। তবে আজ নেমে এসেছিলো। আমি ফিসফিস করে ডাকলাম, এ্যাই খোকাভাই..... খোকাভাই জানতোনা আমি ঐ জানালার ধারে একাকী দাঁড়িয়ে। একটু অবাক হয়ে তাকালো এদিকে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে আমাকে দেখা যাচ্ছিলো না হয়ত। কিন্তু উঠোনের আলো খোকাভায়ের উপরে অল্প এসে পড়ছিলো। খোকাভাই সরে এসে জানালায় আমার হাত ছুঁয়ে বললো, ভয় পাস না...... তারপর দূরে সরে গেলো।
১০ মিনিটের মাঝেই বোধ হয় পুলিশ এসে গেলো। এসেই মোটা রুলটা দিয়ে বেষম এক বাড়ি বসিয়ে দিলো ঐ লিকলিকে লোকটার পায়ে। দাদুভাই হাঁক ছেড়ে উঠলেন। না, ওকে এখানে মারবেন না। যা করার থানায় গিয়ে করেন। এখানে মারা যাবে না। দাদু বড়ই রাশভারী মানুষ ছিলেন আর তার গলাও ছিলো গমগমে। এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তি হওয়ায় পুলিশ এই কথা শুনে কিছু আর বললেন না বোধ হয়। নিঃশব্দে চোরটার দড়ি খুলতে শুরু করলেন। দাদু ফিরে যেতে যেতে সেজচাচাকে বললেন, হীরন লোকটাকে কিছু খাবার দিতে বলো তোমার মাকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পুলিশকে বললেন, আপনারা বসেন, চা দিতে বলছি। ঐ লোকটাকে খাবার পরে নিয়ে যাবেন আর বেশি মারধোরের দরকারও নেই। শরীরের অবস্থা দেখেছেন? কেনো মানুষ চুরি করতে আসে এইভাবে একবার ভেবেছেন?
সকলেই নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। ললিতা মাসী এক থালা ভাত, ডাল, কুমড়ো বড়ি দিয়ে মাগুর মাছ এসব যা যা আমাদের রাতে খেয়ে অবশিষ্ঠ ছিলো তাই বুঝি এনে দিলেন। চোরটা এতক্ষন হাউ মাউ করছিলো। খাবার দেখে তার হাউ মাউ থামিয়ে অবাক চেয়ে রইলো! তার চোখ ঘুরছিলো এর ওর মুখ। সবাই তখন চুপ হয়ে ছিলো। উঠোনে দেওয়া জলচৌকির উপর থালা রেখে উঠোনের মাঝে বসেই গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো লোকটা। একটু পর পর সে এক হাত দিয়ে চোখ মুছছিলো। তবুও খাওয়া থামাচ্ছিলো না। যেন শত বছরের অভুক্ত একজন মানুষ। শুধু মানুষই নয় সমাজের চোখে অপরাধী এক চোর সে। তারও ক্ষুধা তৃষ্ণা আছে, তারও আবেগ আছে, দুঃখ বেদনা আর ভালোবাসাও আছে। শুধু নেই কোনো মান অপমান। আজ জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক সে। যার কান্নার মূল্য হয়ত নেই কারো কাছে কিন্তু সেই রাতে সকলেই দাদুর ঐ একটি বাক্যে চুপ হয়ে গিয়েছিলো। এক ঘৃন্য অপরাধীর দুঃখে হয়ত সকলেই সেদিন প্রাণ কেঁদেছিলো।
সেই রাতের কথা লিখতে গিয়ে আর সেই লোকটার কথা ভেবে আজও আমার চোখে পানি টলমল। চুয়াত্তর ভাইয়া হয়ত ভাববে এটা সত্যিকারের কোনো গরু চোরের গল্প নয় এটাও এক কল্পনার গরু !
সে যাই হোক। এত কিছু ঘটনার মধ্য দিয়েও কিন্তু মা একটাবারের জন্যও ভুললো না আমার ব্যপারটা। তার জীবনের তখন একটাই চাওয়া, একটাই এইম ইন লাইফ সেটা আমাকে বিয়ে দিয়ে উদ্ধার পাওয়া এবং আমার অপরাধের মানে এই পাখনা বৃদ্ধির উচিৎ শিক্ষার ব্যবস্থা করা। আমাকে বিয়ে দিয়ে এই পাপিষ্ঠাকে দোযখ নরক থেকে উদ্ধার করার সাথে সাথে নিজেও একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে চেয়েছিলেন আর কি। আমি ভেবে পাইনা বিয়েই যদি আমার একমাত্র উদ্ধারের পথ হয় তবে কেনো তা আমার পছন্দে নয়? মা বাবার পছন্দেই হতে হবে? এটাও কি এক প্রকার খুন নয়? কি ক্ষতি হয় তাতে মায়েদের? হয়ত অনেকেই বলবে বিয়ের জন্য কখনই চালচুলোহীন পাত্র ভালো নয় তা ও বয়সে ছেলেমেয়েরা বুঝে না, বড়রা বুঝে তাই তারা একটা মেয়ের চাইতে দুগুনো বা তিনগুনো বয়সের স্বামীও ঘাড়ে গছিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু হায় আজ যদি বাংলাদেশের মেয়েদের মনের দূয়ার খুলে খুলে দেখা যেত সেই দূয়ারের অন্তরালে প্রকাশিত হ্ত কতই না দুঃখ বেদনা অভিমান ও অপ্রাপ্তির ইতিহাস। কত হাহাকার, কত আকুলতা, কত ব্যকুলতা। নিজেদের ভালোলাগার ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে ভেসে যাওয়া হলো না তাদের। যেন তাতে সমাজ সংসারের বড় ক্ষতি হয়ে যায়। সারা সমাজ সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তাই নিজেদের মনকে খুন হতে দিতেও মুখ বুজে সয়ে গেলো তারা।
আগের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০২২ রাত ৮:৩২